বরিশালের মুলাদী উপজেলার প্রত্যন্ত প্যাদারহাট গ্রামের এক সাধারণ তরুণ রাহাত হোসেন। তবে তাঁর স্বপ্ন ছিল অসাধারণ। আর সেই স্বপ্নের পথে আলো জ্বেলে দিয়েছিল মায়ের কিনে দেওয়া একটি ল্যাপটপ। নিজের সঞ্চয় ভেঙে দেওয়া এই ল্যাপটপ শুধু একটি যন্ত্র ছিল না, ছিল সন্তানের প্রতি ভালোবাসার প্রতীক। সেই ল্যাপটপকে সঙ্গী করেই রাহাত আজ ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় দুই লাখ টাকার বেশি।
স্বপ্নের শুরু ও মায়ের ত্যাগ
রাহাতের যাত্রা শুরু ২০২২ সালে, যখন তিনি ইউটিউব ও গুগলে ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। কৌতূহল থেকে জন্ম নেওয়া সেই আগ্রহ তাঁকে ২০২৩ সালের শুরুতে স্থানীয় একটি আইটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে ভর্তি হতে অনুপ্রাণিত করে।
কিন্তু পথটা ছিল কঠিন। রাহাতের বাবা মো. খলিলুর রহমান খান দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে অসুস্থ ছিলেন এবং ২০২৫ সালের ৯ জুলাই মারা যান। পরিবারের আর্থিক অবস্থা তখন বেশ দুর্বল। কোর্সের ফি ও একটি ল্যাপটপ কেনা ছিল প্রায় অসম্ভব। তবু মা মোসা. রেহানা পারভীন ৫০ হাজার টাকা জোগাড় করে ছেলেকে একটি আসুস ল্যাপটপ কিনে দেন।
রাহাত বলেন,
“এই ল্যাপটপ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। এটা শুধু একটা যন্ত্র নয়, এটা আমার মায়ের ত্যাগ আর আমাদের পরিবারের নতুন শুরুর প্রতীক।”
তিনি জানান, কোর্সের ফি তিনি একবারে দিতে পারেননি। নিজের হাতখরচ বাঁচিয়ে ছয়–আট মাসের কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করেছিলেন।
প্রথম সাফল্য ও ঘুরে দাঁড়ানো
ল্যাপটপ হাতে পাওয়ার পর রাহাত মনোযোগ দিয়ে শেখা শুরু করেন। স্থানীয় কোর্স শেষে বুঝতে পারেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করার জন্য আরও দক্ষতা দরকার। তখন ফেসবুকে স্কিলআপার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ভিডিও দেখে তিনি ফেসবুক অ্যাডস, গুগল অ্যাডস ও ওয়েব অ্যানালিটিকস বিষয়ে অ্যাডভান্সড কোর্সে ভর্তি হন।
ছয়–আট মাস ছিল কঠোর পরিশ্রমের সময়। প্রতিদিন একটি ভিডিও দেখা এবং দুই–তিনবার অনুশীলন করা ছিল তাঁর অভ্যাস। ফাইভআরে প্রোফাইল খোলার পর প্রথম ছয় মাস কোনো কাজ না পেলেও হাল ছাড়েননি। অবশেষে ইনস্টাগ্রামের এক গ্রাহক তাঁর কাজ দেখে ফাইভআরে প্রথম অর্ডার দেন। কাজটি সময়ের আগেই নিখুঁতভাবে শেষ করে তিনি ৮০ ডলার আয় করেন এবং দুইটি ৫-স্টার রিভিউ পান।
সেখান থেকেই শুরু। বর্তমানে রাহাত ফাইভআরের ‘টপ রেটেড সেলার’।
সাফল্য ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন
রাহাত বর্তমানে সরকারি বরিশাল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। একসময় যিনি হাতখরচ বাঁচিয়ে কোর্সের ফি দিতেন, তিনি এখন নিজের আয়ে নতুন ম্যাকবুক কিনেছেন। মায়ের জন্য নতুন ফোন, সংসারের খরচ, এমনকি তাঁর ছোট ছোট শখ পূরণ করার চেষ্টা করেন নিয়মিত।
এখন তাঁর তিনজনের একটি দল আছে—যাঁরা ফেসবুক ও গুগল অ্যাডস প্রজেক্টে কাজ করেন। রাহাত চান এই টিমকে ১০ জনে উন্নীত করতে এবং নিজস্ব একটি ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করতে।
“আমি চাই আমার এলাকার ছেলেমেয়েরা যেন আমার মতো সংগ্রাম না করে। তারা যেন সুযোগ পায়, শেখে আর বড় কিছু করে দেখায়,” বলেন রাহাত।
বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে। তাঁর লক্ষ্য, এই আয়কে পাঁচ লাখ টাকায় উন্নীত করা এবং গ্রামীণ তরুণদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।
🔸 বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ছয় লাখ তরুণ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত, যারা রাহাতের মতো ঘরে বসেই আয় করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।
